তখন মধ্যরাত্রি। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে ভাবছে,আবার সূর্যের আলো নীল আকাশের বুক চিরে বেরিয়ে আসবে। আবার একটা নতুন দিনের সূচনা! অসহ্য! অসহ্য! মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে, বিছানায় ছটফট করতে করতে পাশ ফিরে শুলো নীল।
সূর্য ওঠার সঙ্গে নীলের কেন যে অসহ্য লাগে তা নীলই জানে।
বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে, এক সময় নীল ঘুমিয়ে পড়লো৷
রাত তখন প্রায় দুটো। ঘুমালো ঠিক, কিন্তু, ভালো ঘুম হলো না। আলস্যে ভরা, ঘুম জড়ানো চোখে, এক সময় নীল জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। হেমন্তের ভোরের হাওয়াটা মন্দ লাগছে না ওকে। সোনালি পালঙ্কের উপর শুয়ে৷ জানালা দিয়ে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকছে৷ ঠাণ্ডা হাওয়ায় সোনালির ঘুমটা ভেঙে গেলো। পাশে নীল নেই। সাতসকালে ও কোথায় গেলো!
এক সময় সোনালির চোখ গেলো জানালার দিকে৷ ওখানে দাঁড়িয়ে নীল৷ সোনালির মনে কৌতূহল দেখা দিলো৷ এখনো সূর্যের আলো ভালো করে ফোটেনি, তবে ওখানে দাঁড়িয়ে নীল কী করছে!
এক সময় নীলের পাশে গিয়ে ও দাঁড়ালো। বাইরে চোখ মেলেই সোনালি বললো-
বাঃ! কী সুন্দর সকাল! কুয়াশা না থাকলে আরো ভালো লাগতো,তাই না নীল? তাই হয়তো লাগতো।
সোনালি কি যেন বলতে যাচ্ছিল, ওকে থামিয়ে নীল বললো –
জানো সোনালি, সবাই ভোরের সূর্য দেখে আনন্দ পায়, কিন্তু আমাকে অসহ্য লাগে। একদম ভালো লাগে না।
কেন ভালো লাগে না?
জানো, প্রত্যেক দিন সূর্য ওঠা মানে আমরা একদিন করে ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই। যত ঝক্কি, ঝামেলা,কৈফিয়ৎ,তলব, দেওয়া, নেওয়া এবং ফাই-ফরমাস শুরু৷ যতক্ষণ রাত ততক্ষণ স্বস্তি৷
নীলের কথায় মৃদু হাসলো সোনালি৷ নীলের বুঝতে অসুবিধে হলো না,ওর কথায় সোনালি হাসলো। তবুও জিজ্ঞেস করলো,,
-তুমি হাসলে যে?
এমনি,,,
এমনি এমনি কেউ হাসে না সোনালি, তাই জানি৷ তুমি কি আমাকে বিদ্রুপ করে হাসলে!
বিদ্রুপ কিনা তা জানি না। তবে তুমি যে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর লোক তা বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার।বোধহয় তুমি জীবন যন্ত্রণায় ভুগছো নীল। তাই নানা ধরণের হতাশা তোমাকে গ্রাস করছে। আর ঐ হতাশা থেকেই তুমি ওসব কথা বলছো। আমি কি ঠিক বলেছি নীল!
নিশ্চুপ নীল,,,
জানো নীল, সূর্য হলো চির সত্যের প্রতীক। প্রতিদিন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই হলো সূর্যের কাজ।
প্রতিদিন সূর্য ওঠে আর অস্ত যায়। এই আসা যাওয়ার মাঝেই তো নতুন আর পুরানোর খেলা।
তুমি কী বলতে চাইছো সোনালী?
আরে মশাই, পুরানো না সরলে নতুন আসবে কেমন করে? পুরানোকে সরিয়ে, নতুনের স্থান করে দেওয়াই তো সূর্যের কাজ। সূর্য যদি এটা না করতো, তাহলে তো পৃথিবীর মাটি পুরানো, ধূসর আর কালো জরাজীর্ণতে পরিণত হয়ে যেত৷ প্রতিদিন সূর্য ওঠে মানে নতুনের সূচনা। নতুনের সূচনা মানে পুরানোর বিদায়। আসা আর যাওয়া। এটাই পৃথিবীর গতি। আর একেই কিনা তুমি অসহ্য বলছো নীল!
সোনালির কথায় নীল কি যেন বলতে যাচ্ছিলো,,,
ওকে থামিয়ে সোনালি বললো–
দেখো নীল, ব্যক্তি স্বার্থ, ব্যক্তি বিদ্বেষ, এসব অপরের গায়ে চাপানো ঠিক নয়। সবকিছু বিচার বিবেচনা করে যেমন চলতে হয়, তেমনি কথাবার্তাও। নইলে প্রতি পদক্ষেপে হোঁচট খেতে হয়। যদিও মানুষ হোঁচট খেতে খেতেই শেখে৷ তবুও বলছি, সাবধানের মার নেই।
ভোরের সূর্য তখন ভুবনদের তেঁতুল গাছের উপর অনেকটাই প্রভাব বিস্তার করেছে। বাইরের জগৎ থেকে দৃষ্টি ভেতরে এনে বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলো নীল। তারপর আবেগাপ্লুত হয়ে সোনালির দিকে তাকিয়ে রইলো৷ সোনালির দৃষ্টি এড়ালো না৷
এমনভাবে কী দেখছো নীল?তোমাকে,,,
এর আগে বোধহয় দেখোনি?
আগের দেখার সঙ্গে আজকের দেখার অনেক পার্থক্য রয়েছে সোনালি,তাই দেখছি।
তা,দেখে কী বুঝলে মশাই?
বুঝলাম, সূর্যের আলো ফোটা মানেই নতুন দিনের সূচনা৷ আর নতুনদিন মানেই জীর্ণতা, হীনমন্যতা, মনোমালিন্য, হিংসা, বিদ্বেষ সব কিছু দূরে সরিয়ে রেখে নতুনের শ্বাস নেওয়া তাইতো?
গম্ভীরভাবে সোনালী বললো- হুমম,,,
জানো সোনালি, আজ তুমি আমার হৃদয়টাকে ঢিল ছুঁড়ে সব অন্ধকার দূর করে দিলে। তারপর কি বলোতো নীল!
কী?,,
তারপর আবার প্রতীক্ষা, নতুন একটা সূর্য ওঠা ভোরের৷
কথাটা বলেই সোনালি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। বাধা দিয়ে নীল বললো,,,
না, চলে যেও না সোনালি। তুমি চলে গেলেই অন্ধকার ভর করবে। তুমি আমার সোনালি সূর্যের সকাল৷ তুমি দাঁড়িয়ে থাকো আমার কাছটিতে। পাগলামো করো না নীল৷ সকাল মানেই কর্ম ব্যস্ততা। মেলা কাজ পড়ে আছে,,,
ওসব পরে হবে।
কথাটা বলেই, সোনালিকে জড়িয়ে ধরলো৷
আঃ, একী করছো নীল?ছাড়ো,,,
না, তোমাকে ছাড়বো না৷
কী করবে?
তুমি আমার সোনালী সূর্যের সকাল হয়ে, আমার বাগানে ফুল ফোটাও সোনালি।
ছাড়ো,,,একী করছো? সূর্যের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। সবাই উঠে পড়েছে।
কেউ চলে আসবে। আসবেই তো সোনালী।
কে? কে আসবে?
তোমার মাটিতে পোঁতা আমার বীজ। সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়েই তো আর একটা নতুন সূর্যের সকাল সৃষ্টি হবে।
ভুবনদের তেঁতুল গাছের মাথায় উপর দিয়ে একটা পাখি, খোকা হোক, খুকু হোক, করে ডাকতে ডাকতে পূব থেকে উত্তর আকাশে মিলিয়ে গেলো৷