ঢাকা ১০:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ২৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পলক রহমান এর গল্প || স্বপ্নের মৃত্যু

  • আপ : ০১:০৯:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ অগাস্ট ২০২৪
  • ৭০৯ ভিউ :

 

ভূ-প্রকৃতির আলোকে উত্তরে এভারেস্টের পর্বতমালা এবং পুরো উত্তর পশ্চিম জুড়েই ইন্ডিয়া এবং প্রাকৃতিক ভাবে বাংলাদেশ সবচাইতে দক্ষিনে সমুদ্র বে-অব-বেঙ্গলের অববাহিকায় হওয়ায় এভারেস্টের বরফগলা জল আর অতি বৃষ্টির কারনে প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশের কোন না কোন স্থানে বন্যা লেগেই থাকে।
বন্যা এমনই একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা শুধু কৃষকের জন্যই এক মহা-অভিশাপ নয়। বরং গোটা জাতিতেই নেমে আসে দু:খের দিন। ফসল, শাক, স্বব্জি নষ্ট হয়। গরু ছাগল, হাস মুরগী এমন কি পোষা কুকুর আর বিড়ালটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্বলসহ মানুষজনের অনেক কিছু হারিয়ে যায়। কিছু মানুষ মারাও যায় প্রতি বছর। যারা বেঁচে থাকে তাদের জীবনেও নেমে আসে ভয়াবহ দুঃখের কালােরাত্রি। অনেকদিন ধরে চলতে থাকে দু:খের দিন।

তবে এবারের বন্যা ছিল যত না অতি বৃষ্টির কারনে তার চেয়ে কারনটা ছিল কিছুটা কৃত্রিম, মানুষ সৃষ্ট বলেই প্রতিয়মান হয়। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইন্ডিয়া গোমতি নদীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ড্যাম বা বাঁধ নির্মান করেছে। নাম ডম্বুর বাঁধ। সেই বাঁধের গেট নাকি একটা অস্বাভাবিক উচ্চতায় পানি জমা হলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে খুলে যায়। তাই যদি হয় তাহলে বাঁধে যখন পানির উচ্চতা বাড়ছিল তখন তারা জানালো না কেন যে বৃষ্টির পানি বেড়ে বাঁধে যে উচ্চতায় এসেছে তাতে করে বাঁধের মুখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে কোন সময় খুলে যেতে পারে। ফলে প্রচন্ড স্রোতে সেই পানি নদীর পাড় উপচিয়ে নদী শাসনের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে বন্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাই নিম্ন অঞ্চলের সকল জনপদের মানুষ যেন সতর্ক থাকে এবং সময়মত নিরাপদ স্থানে যাওয়ার ব্যাবস্থা নেয়।
গত ২০ আগষ্ট ২০২৪, সকাল থেকে রাত্রিতে ঘুমোতে যাওয়ার আগেও খোদেজা বেগমের সোনার সংসারে ছিল আনন্দ মুখোর আর অনেক সুখের। সকালে আকাশে কিছুটা ঘন কালো মেঘ থাকলেও এবং বিকেলে বৃষ্টি হলেও সব কিছুই ছিল প্রায় স্বাভাবিক। বৃষ্টির কাদা জল মাড়িয়ে গরুর পাল সন্ধ্যায় গোয়ালে ফিরেছে। তাদের খাবারের ব্যাবস্থা হয়েছে, ছাগল ভেড়া যার যার থাকার জায়গায় ফিরে জাবর কাটতে শুরু করেছে, হাস মুরগীরা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে রাতের অবকাসে নীরব হয়েছে। খোদেজা তার মেয়েকে নিয়ে সময়মত রাতের খাবার খেয়ে বাড়িতেই আশ্রিত ফাতেমার বুয়ার সাথে প্রয়োজনীয় আয়োজনের কথা সেরে ঘরে এসে খাটের উপর বসতেই ফেন্সি বলে:
– মা আজ আমি তোমাকে পান বানিয়ে দেবো। মা বলে:
– মেয়ের নিশ্চই আজ পান খেতে ইচ্ছে করেছে তাই না। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি গেলে তোকে পান খেতে দেবে কে মা?
– কেন আমার শ্বাশুড়ি।
– ভালো কথা তোর শ্বাশুড়ি কি পান খায়? তা তো জানা হয়নি।
– কি করে জানবে। সেদিন তো শুধু ছেলের বাবা, দুই একজন মুরুব্বি, ছেলে আর তার কিছু বন্ধু এসেছিল। তোমার হবু বিয়াইন তো আসেনি।
– আসলেই ছেলের মা আসলে ভালোই হত। তোর বাবা থাকলে কত যে খুশি হত। এ কথা বলতে বলতেই খোদেজা আঁচলে চোখ মুছতে থাকে। ফেন্সি মা’কে শান্তনা দেয়। বলে:
– থাক মা, বাবার কথা মনে করে আর কেঁদো না। তবে ছেলে পক্ষকে বলেছ যে বিয়ের পরে আমি তোমার কাছেই থাকব? তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
– তা কি হয় মা। বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িই মেয়েদের আসল বাড়ি।
– ওগুলো পুঁথি, উপন্যাস আর গল্পের কথা। আমি মানতে চাই না। আমার বাড়িই আসল বাড়ি। বরং শ্বশুর বাড়িই অস্থায়ী বাড়ি। যে বাড়িতে মা মেয়েকে জন্ম দিয়ে পেলে পুষে বড় করল, সে বাড়ি কেন উপেক্ষিত হবে। শ্বশুর বাড়ি কেন হবে আসল বাড়ি?

খোদেজা মেয়ের যুক্তির কাছে পেরে উঠে না। বলে:
– আচ্ছা ছেলের বাবা-মা’কে বলব তাদের ছেলেকে যেন আমাদের বাড়িতে থাকার জন্য পরামর্শ দেয়। আর তা না হলে অন্তত অর্ধেক মাস করে হলেও সে যেন আমাদের এখানে থাকে।
– আমি না থাকলে তোমাকে দেখবে কে বল? তাই তোমাকে ছেড়ে আমি কোত্থাও যেতে চাই না।
– ভাবিস না মা। ফাতেমা আছে না, ও তো এ বাড়িতেই বড় হল। ও থাকলেই সময় কেটে যাবে।
– ও, তার মানে আমাকে পর করতে পারলেই তুমি বাঁচ তাই না মা? বলেই ফেন্সির চোখে অভিমানের জল চিক চিক করে উঠে। খোদেজা বেগম বুঝতে পারে। আদর করে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। তার চোখেও এখন জল। বলে:
– কোন মা কি পারে তার বুকের ধনকে পরের ঘরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে বা সুখে থাকতে। পারে না মা, কোন মা’ই পারে না। কিন্তু সমাজের নিয়ম তাই বাধ্য হয়ে মেয়েকে পরের হাতে তুলে দিতে হয়।
ফেন্সি আর কথা বাড়ায় না। মা বলে:
– সকালে কাজ আছে। এখন ঘুমিয়ে পড় মা।

মাঝরাতের দিকে খোদেজা বেগম হঠাৎ পিঠের নীচে পানিতে ভিজে গেছে টের পায়। প্রথমে হকচকিয়ে যায়! ভাবে পানি কোথা থেকে এলো। টেবিলে রাখা পানির জগ কি উলটে পড়েছে? ফেন্সি পানি খেতে গিয়ে কি গ্লাস পড়ে গিয়েছে? কি হতে পারে। চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড ভাবতেই দেখে সে আর ফেন্সি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে প্রায়। বিছানা থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসতেই দেখে ফেন্সিও আতংকে উঠে কাঁপছে। কি হল? ঘরের আলো জ্বালানোর জন্য সুইচ বোর্ডের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে দেখে ঘরে সাঁতার পানি ঢুকে থৈ থৈ করছে। কোন রকমে সুইচের কাছে পৌঁছাতে পারলেও দেখে বিদ্যুৎ নেই। খোদেজার বুক হাহাকার করে উঠে। বাইরে প্রচন্ড পানির স্রোত। তার স্মরণকালেও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি খোদেজা। সে যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। সম্বিত ফিরে পেতেই ফেন্সিকে তার হাতের মুঠোয় ধরে ঘরের বাইরে এসে দেখে চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। কোথাও প্রচন্ড শ্রোতের আওয়াজ। কত ঘর বাড়ি, গাছপালা ইতি মধ্যেই ভেঙ্গে পড়েছে। তাদের বাড়ির বারান্দার ছাদ ছুঁই ছুঁই করছে পানিতে। আধাপাকা টিনের শক্ত চালের বাড়ি দেখে তা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কোন কূল কিনারা না পেয়ে খোদেজা বেগম ফেন্সি আর ফাতেমাকে নিয়ে ঘরের চালে আশ্রয় নেয়। পরে উদ্ধার কর্মীদের সহায়তায় তারা তিনজন তিন কি:মি: দূরে ঢাকা-চিটাগং মহা সড়কের উঁচু এক স্থানে অতি কষ্টে গৃহহীন অনেকের মত কোনরকমে ঠাঁই নিয়েছে।

খোদেজা বেগমের কান্না এখনও থামছে না। তার কান্নার মাতমের মধ্যেই সে উচ্চস্বরে বলছে “একটু আগেও যদি জানতাম ইন্ডিয়ার ড্যামের পানি ঢুকে ভাটি এলাকার সকল লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাহলে তো আমরা নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিতে পারতাম আগেই।”
এই বন্যায় খোদেজা বেগমের সংসারের সহায় সম্বল ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি গোয়ালের গরু, ছাগল, হাস মুরগী সব ভেসে গেছে। ছেলে পক্ষ অবিবাহিত একমাত্র যুবতী মেয়ে ফেন্সিকে দেখে পাকা কথা দিয়েছিল যে, আসছে সেপ্টেম্বরের তিন তারিখে তারা বিয়ে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে যাবে। ছেলে বিদেশে সৌদি আরবে চাকুরী করে। খুব পরহেজগার ছেলে। সৌদি আরবে মদিনা শহরের এক দোকানে সেলসম্যানের চাকুরী করে।
খোদেজা বেগম তার এই একমাত্র মেয়ে ফেন্সিকে জন্ম দেয়ার সময়ই তার বাবাকে হারিয়েছিল। এক সড়ক দুর্ঘটক তিনি মারা যান। সেই থেকে খোদেজা বেগম নিজে আর বিয়ে না করে এই মেয়েকে বুকে নিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলেন এই সংসার। কি ছিল না সংসারে। ১০ বিঘা জমিতে শস্য ও ধানের ক্ষেত, গোয়ালে গাইগরুসহ দুইজোড়া হালের বলদ, ছাগল ভেড়ার পাল, হাস মুরগীর ছোট্ট খামার, পুকুর ভরা মাছ। আজ খোদেজা বেগম সব হারিয়ে নিস্ব। বন্যার পানি নেমে গেলে হয়ত জমি আর বাড়ির ভিটেটুকু পাবে। কিন্তু জমিতে বানের পানির যে বালুর স্তর পড়বে তা সরিয়ে আবার আবাদ যোগ্য করে তুলতে আর পারবে কি না, মেয়ের বিয়েরই বা কি হবে!

খুব ইচ্ছে ছিল পালা ছাগল জবাই করে মেয়ের বিয়ে দিবে। জামাই এলে বাড়ির পালা মোরগ ধরে তার মাংস খাওয়াবে নতুন জামাইকে। তাই মুরগীগুলোকে খোদেজা খুব যত্ন নিয়ে চোখে চোখে রাখত। আর গাভীর দুধ দিয়ে পায়েস রেঁধে জামাইয়ের মা-বাবাকে খাওয়াবে। কত স্বপ্ন চোখে ভীড় করেছিল। কত আশা ছিল তার, মেয়ে বড় হয়েছে, এতদিন পরে একটা নতুন আত্মীতা হতে যাচ্ছে তাদেরকে আপ্যায়ন করতে যেন কোন কমতি না থকে। অথচ বন্যায় সব ভেসে গেছে। বাড়ির কি অবস্থা সে খবরও আর জানে না আজ প্রায় তিনদিন হল। এ সব বলে বলে প্রলাপের মত খোদেজা বেগম বকছে আর বুক চাপড়িয়ে উচ্চ স্বরে কাঁদছে। ফেন্সি মাকে ধৈর্য ধরতে বলছে। ফেন্সি বলে:
– মা কেঁদো না। সব কিছু হারালেও তো আমরা বেঁচে আছি। দেখবে আবার আমরা গেরস্ত বাড়ি সাজাব, ক্ষেত খামার করব।
– আমার কি আর সে বয়স আছে মা? আমি আর পারব না, তোর বিয়েরই বা কি হবে। ঐ নতুন সম্পর্কের লোকজনেরাই কেমন আছে কে জানে। হায় আল্লাহ এ কেমন গজব দিলে তুমি!
– মা তুমি ভাবছ কেন। আমরা জেনারেশন জেডের ছেলে মেয়ে যাকে বলে জেন জি। ক’দিন আগেই আমরা সাহসের সাথে লড়াই করে আমাদের প্রানের বাংলাদেশকে ১৬ বছরের ফেসীবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত করেছি, দেশকে আবার স্বাধীন করেছি। আমরা পারব মা। তুমি শুধু দোয়া করবে। খোদেজা বেগম তখনও কাঁদছিল আর বলছিল:
– তোর বিয়ের কি হবে মা?
– সে নিয়ে তুমি ভেবো না। আগে বাঁচতে হবে। তার পরে দেখা যাবে সে সব।খোদেজা বেগম কান্না থামিয়ে বলল:
– খাওয়ার জন্য তো কিছুই নেই। শুনেছি ত্রান দিচ্ছে রাস্তার মোড়ে। ফাতেমা গেছিল?
– গেছিল মা। তবে একজনের জন্য একটিই ত্রানের ব্যাগ দিয়েছে।
– তুইও গেলি না কেন মা?
– আমার ইতস্তত লাগে মা। শুনেছি ত্রান দেয়ার সময় অনেকে ছবি তোলে। আমরা কি ভিখেরী, হতদরিদ্র? আমাদের অনেক কিছু ছিল। আজ না হয় পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আমাদেরকে হাত পেতে ত্রান নিতে হোচ্ছে। তাই বলে সে ছবি তুলে মিডিয়ায় দিবে, আমার ইচ্ছে করে না।
মা চুপ করে থাকে। এদিকে আজকেও ফাতেমা যে ত্রানটুকু পেয়েছে সে গুলোই গুছিয়ে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
খাওয়ার সময় ফাতেমা বলছিল:
– বড় মা, আমি ফেন্সি আপুর হবু শ্বশুরকে আজ ত্রান নিতে দেখেছি। কিন্তু ভীড়ের মধ্যে কোথায় যে হারিয়ে গেল আর দেখা পাইনি। খোদেজা বেগম বলে:
– ওমা বলিস কি? সাথে কি হবু জামাই ছিল?
– না উনাকে দেখিনি।
– আল্লাহ তুমি সকলকে ভালো রেখো।

এদিকে কয়েকদিন পরে বন্যার পানি সরে গিয়ে গ্রামে যাওয়ার রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে গেলেও লোকজন ঘরে ফিরতে শুরু করে। খোদেজা বেগমও আর দেরী করতে চাইল না। তারা বাড়ির দিকে রওনা দিল। বাড়ির বেহাল অবস্থা দেখে খোদেজা বেগম কাঁদতে কাঁদতে মুর্চ্ছা গেল। শরীর খারাপ করল। ফেন্সি মা’কে ঘরে নিয়ে যে কোন কিছুর উপরে শুইয়ে দিবে সে সুজোগও নেই। অগত্যা কাদা মাখা বারান্দায় ত্রানের ত্রিপাল বিছিয়ে মা’র সেবা শুশ্রুষা করা শুরু করল সে। মা একটু সুস্থ হলে মা’র হাত পা পানি দিয়ে ধুইয়ে দিল। মাথায় শক্ত কাগজের সাহায্যে বাতাস দিতে থাকল। হঠাত বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে খোদেজা বেগমের মনটা ছেঁত করে উঠল। ফেন্সিকে বলেই ফেলল দেখ তো মা তোর হবু শ্বশুর এলো কি না? দেখে সত্যিই ফেন্সির হবু শ্বশুর বাড়ির আঙ্গিনায় কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে। খোদেজা বেগম বলল:
– বিয়াইকে বসতে দে মা। বিয়াই সাহেব বসেন। কিসে আর বসতে দেবো বলেন আজ আর কিছুই নেই বাড়িতে। আমার সোনার সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে বিয়াই বলতে বলতে আবার কাঁদতে শুরু করে। বিয়াইও কাঁদতে কাঁদতে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করল:
– মুনির কি আপনাদের কাছে এসেছিল বিয়ান??
– কেন বিয়াই? মুনিরের (হবু জামাই) কি হয়েছে।
– ২৫ আগষ্ট বন্যায় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে যখন তার ভেতরেই বার বার ফেন্সি ফেন্সি নাম ধরে বলেছে ওদের কি হল বাবা? ওরা কি বেঁচে আছে? আমি ফেন্সিদের কাছে যাব। ছেলে যে এক নজর দেখে ফেন্সিকে এত ভালোবেসে ফেলেছিল তা বুঝতেই পারিনি। সেদিনই সে বিকেলের দিকে পাগলের মত আপনাদেরকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। তারপর…
– তারপর, তার পর কি হয়েছে বিয়াই, সে এখন কোথায়?
– সে খোঁজ নিতেই আপনাদের কাছে এসেছিলাম। এই বলেই তিনি আবারও কাঁদতে থাকেন।
– এ কি বলছেন আপনে। মুনির নিশ্চই আছে। সে হারিয়ে যেতে পারে না। সে অবশ্যই ফিরে আসবে।
বলতে বলতে খোদেজা বেগম আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আড়ালে থেকে ফেন্সি সব শুনছিল। সে এবার আর নিজেকে প্রবোধ দিতে পারল না। এতক্ষন মা’কে কত বুঝিয়েছ যেন সে আর কান্না না করে। কিন্তু মুনিরের কথা জানার পর সেও আর নিজেকে সামলাতে পারল না। দৌড়ে এসে হবু শ্বশুরের বুকে কান্নায় লুটে পড়ে। আর বলতে থাকে চলেই যদি যাবে মুনির তাহলে আমাকে কেন এত ভালোবেসেছিল?

২৯ আগস্ট, ২০২৪।

পলক রহমান এর গল্প || স্বপ্নের মৃত্যু

আপ : ০১:০৯:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ অগাস্ট ২০২৪

 

ভূ-প্রকৃতির আলোকে উত্তরে এভারেস্টের পর্বতমালা এবং পুরো উত্তর পশ্চিম জুড়েই ইন্ডিয়া এবং প্রাকৃতিক ভাবে বাংলাদেশ সবচাইতে দক্ষিনে সমুদ্র বে-অব-বেঙ্গলের অববাহিকায় হওয়ায় এভারেস্টের বরফগলা জল আর অতি বৃষ্টির কারনে প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশের কোন না কোন স্থানে বন্যা লেগেই থাকে।
বন্যা এমনই একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা শুধু কৃষকের জন্যই এক মহা-অভিশাপ নয়। বরং গোটা জাতিতেই নেমে আসে দু:খের দিন। ফসল, শাক, স্বব্জি নষ্ট হয়। গরু ছাগল, হাস মুরগী এমন কি পোষা কুকুর আর বিড়ালটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্বলসহ মানুষজনের অনেক কিছু হারিয়ে যায়। কিছু মানুষ মারাও যায় প্রতি বছর। যারা বেঁচে থাকে তাদের জীবনেও নেমে আসে ভয়াবহ দুঃখের কালােরাত্রি। অনেকদিন ধরে চলতে থাকে দু:খের দিন।

তবে এবারের বন্যা ছিল যত না অতি বৃষ্টির কারনে তার চেয়ে কারনটা ছিল কিছুটা কৃত্রিম, মানুষ সৃষ্ট বলেই প্রতিয়মান হয়। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইন্ডিয়া গোমতি নদীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ড্যাম বা বাঁধ নির্মান করেছে। নাম ডম্বুর বাঁধ। সেই বাঁধের গেট নাকি একটা অস্বাভাবিক উচ্চতায় পানি জমা হলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে খুলে যায়। তাই যদি হয় তাহলে বাঁধে যখন পানির উচ্চতা বাড়ছিল তখন তারা জানালো না কেন যে বৃষ্টির পানি বেড়ে বাঁধে যে উচ্চতায় এসেছে তাতে করে বাঁধের মুখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে কোন সময় খুলে যেতে পারে। ফলে প্রচন্ড স্রোতে সেই পানি নদীর পাড় উপচিয়ে নদী শাসনের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে বন্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাই নিম্ন অঞ্চলের সকল জনপদের মানুষ যেন সতর্ক থাকে এবং সময়মত নিরাপদ স্থানে যাওয়ার ব্যাবস্থা নেয়।
গত ২০ আগষ্ট ২০২৪, সকাল থেকে রাত্রিতে ঘুমোতে যাওয়ার আগেও খোদেজা বেগমের সোনার সংসারে ছিল আনন্দ মুখোর আর অনেক সুখের। সকালে আকাশে কিছুটা ঘন কালো মেঘ থাকলেও এবং বিকেলে বৃষ্টি হলেও সব কিছুই ছিল প্রায় স্বাভাবিক। বৃষ্টির কাদা জল মাড়িয়ে গরুর পাল সন্ধ্যায় গোয়ালে ফিরেছে। তাদের খাবারের ব্যাবস্থা হয়েছে, ছাগল ভেড়া যার যার থাকার জায়গায় ফিরে জাবর কাটতে শুরু করেছে, হাস মুরগীরা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে রাতের অবকাসে নীরব হয়েছে। খোদেজা তার মেয়েকে নিয়ে সময়মত রাতের খাবার খেয়ে বাড়িতেই আশ্রিত ফাতেমার বুয়ার সাথে প্রয়োজনীয় আয়োজনের কথা সেরে ঘরে এসে খাটের উপর বসতেই ফেন্সি বলে:
– মা আজ আমি তোমাকে পান বানিয়ে দেবো। মা বলে:
– মেয়ের নিশ্চই আজ পান খেতে ইচ্ছে করেছে তাই না। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি গেলে তোকে পান খেতে দেবে কে মা?
– কেন আমার শ্বাশুড়ি।
– ভালো কথা তোর শ্বাশুড়ি কি পান খায়? তা তো জানা হয়নি।
– কি করে জানবে। সেদিন তো শুধু ছেলের বাবা, দুই একজন মুরুব্বি, ছেলে আর তার কিছু বন্ধু এসেছিল। তোমার হবু বিয়াইন তো আসেনি।
– আসলেই ছেলের মা আসলে ভালোই হত। তোর বাবা থাকলে কত যে খুশি হত। এ কথা বলতে বলতেই খোদেজা আঁচলে চোখ মুছতে থাকে। ফেন্সি মা’কে শান্তনা দেয়। বলে:
– থাক মা, বাবার কথা মনে করে আর কেঁদো না। তবে ছেলে পক্ষকে বলেছ যে বিয়ের পরে আমি তোমার কাছেই থাকব? তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
– তা কি হয় মা। বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িই মেয়েদের আসল বাড়ি।
– ওগুলো পুঁথি, উপন্যাস আর গল্পের কথা। আমি মানতে চাই না। আমার বাড়িই আসল বাড়ি। বরং শ্বশুর বাড়িই অস্থায়ী বাড়ি। যে বাড়িতে মা মেয়েকে জন্ম দিয়ে পেলে পুষে বড় করল, সে বাড়ি কেন উপেক্ষিত হবে। শ্বশুর বাড়ি কেন হবে আসল বাড়ি?

খোদেজা মেয়ের যুক্তির কাছে পেরে উঠে না। বলে:
– আচ্ছা ছেলের বাবা-মা’কে বলব তাদের ছেলেকে যেন আমাদের বাড়িতে থাকার জন্য পরামর্শ দেয়। আর তা না হলে অন্তত অর্ধেক মাস করে হলেও সে যেন আমাদের এখানে থাকে।
– আমি না থাকলে তোমাকে দেখবে কে বল? তাই তোমাকে ছেড়ে আমি কোত্থাও যেতে চাই না।
– ভাবিস না মা। ফাতেমা আছে না, ও তো এ বাড়িতেই বড় হল। ও থাকলেই সময় কেটে যাবে।
– ও, তার মানে আমাকে পর করতে পারলেই তুমি বাঁচ তাই না মা? বলেই ফেন্সির চোখে অভিমানের জল চিক চিক করে উঠে। খোদেজা বেগম বুঝতে পারে। আদর করে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। তার চোখেও এখন জল। বলে:
– কোন মা কি পারে তার বুকের ধনকে পরের ঘরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে বা সুখে থাকতে। পারে না মা, কোন মা’ই পারে না। কিন্তু সমাজের নিয়ম তাই বাধ্য হয়ে মেয়েকে পরের হাতে তুলে দিতে হয়।
ফেন্সি আর কথা বাড়ায় না। মা বলে:
– সকালে কাজ আছে। এখন ঘুমিয়ে পড় মা।

মাঝরাতের দিকে খোদেজা বেগম হঠাৎ পিঠের নীচে পানিতে ভিজে গেছে টের পায়। প্রথমে হকচকিয়ে যায়! ভাবে পানি কোথা থেকে এলো। টেবিলে রাখা পানির জগ কি উলটে পড়েছে? ফেন্সি পানি খেতে গিয়ে কি গ্লাস পড়ে গিয়েছে? কি হতে পারে। চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড ভাবতেই দেখে সে আর ফেন্সি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে প্রায়। বিছানা থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসতেই দেখে ফেন্সিও আতংকে উঠে কাঁপছে। কি হল? ঘরের আলো জ্বালানোর জন্য সুইচ বোর্ডের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে দেখে ঘরে সাঁতার পানি ঢুকে থৈ থৈ করছে। কোন রকমে সুইচের কাছে পৌঁছাতে পারলেও দেখে বিদ্যুৎ নেই। খোদেজার বুক হাহাকার করে উঠে। বাইরে প্রচন্ড পানির স্রোত। তার স্মরণকালেও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি খোদেজা। সে যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। সম্বিত ফিরে পেতেই ফেন্সিকে তার হাতের মুঠোয় ধরে ঘরের বাইরে এসে দেখে চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। কোথাও প্রচন্ড শ্রোতের আওয়াজ। কত ঘর বাড়ি, গাছপালা ইতি মধ্যেই ভেঙ্গে পড়েছে। তাদের বাড়ির বারান্দার ছাদ ছুঁই ছুঁই করছে পানিতে। আধাপাকা টিনের শক্ত চালের বাড়ি দেখে তা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কোন কূল কিনারা না পেয়ে খোদেজা বেগম ফেন্সি আর ফাতেমাকে নিয়ে ঘরের চালে আশ্রয় নেয়। পরে উদ্ধার কর্মীদের সহায়তায় তারা তিনজন তিন কি:মি: দূরে ঢাকা-চিটাগং মহা সড়কের উঁচু এক স্থানে অতি কষ্টে গৃহহীন অনেকের মত কোনরকমে ঠাঁই নিয়েছে।

খোদেজা বেগমের কান্না এখনও থামছে না। তার কান্নার মাতমের মধ্যেই সে উচ্চস্বরে বলছে “একটু আগেও যদি জানতাম ইন্ডিয়ার ড্যামের পানি ঢুকে ভাটি এলাকার সকল লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাহলে তো আমরা নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিতে পারতাম আগেই।”
এই বন্যায় খোদেজা বেগমের সংসারের সহায় সম্বল ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি গোয়ালের গরু, ছাগল, হাস মুরগী সব ভেসে গেছে। ছেলে পক্ষ অবিবাহিত একমাত্র যুবতী মেয়ে ফেন্সিকে দেখে পাকা কথা দিয়েছিল যে, আসছে সেপ্টেম্বরের তিন তারিখে তারা বিয়ে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে যাবে। ছেলে বিদেশে সৌদি আরবে চাকুরী করে। খুব পরহেজগার ছেলে। সৌদি আরবে মদিনা শহরের এক দোকানে সেলসম্যানের চাকুরী করে।
খোদেজা বেগম তার এই একমাত্র মেয়ে ফেন্সিকে জন্ম দেয়ার সময়ই তার বাবাকে হারিয়েছিল। এক সড়ক দুর্ঘটক তিনি মারা যান। সেই থেকে খোদেজা বেগম নিজে আর বিয়ে না করে এই মেয়েকে বুকে নিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলেন এই সংসার। কি ছিল না সংসারে। ১০ বিঘা জমিতে শস্য ও ধানের ক্ষেত, গোয়ালে গাইগরুসহ দুইজোড়া হালের বলদ, ছাগল ভেড়ার পাল, হাস মুরগীর ছোট্ট খামার, পুকুর ভরা মাছ। আজ খোদেজা বেগম সব হারিয়ে নিস্ব। বন্যার পানি নেমে গেলে হয়ত জমি আর বাড়ির ভিটেটুকু পাবে। কিন্তু জমিতে বানের পানির যে বালুর স্তর পড়বে তা সরিয়ে আবার আবাদ যোগ্য করে তুলতে আর পারবে কি না, মেয়ের বিয়েরই বা কি হবে!

খুব ইচ্ছে ছিল পালা ছাগল জবাই করে মেয়ের বিয়ে দিবে। জামাই এলে বাড়ির পালা মোরগ ধরে তার মাংস খাওয়াবে নতুন জামাইকে। তাই মুরগীগুলোকে খোদেজা খুব যত্ন নিয়ে চোখে চোখে রাখত। আর গাভীর দুধ দিয়ে পায়েস রেঁধে জামাইয়ের মা-বাবাকে খাওয়াবে। কত স্বপ্ন চোখে ভীড় করেছিল। কত আশা ছিল তার, মেয়ে বড় হয়েছে, এতদিন পরে একটা নতুন আত্মীতা হতে যাচ্ছে তাদেরকে আপ্যায়ন করতে যেন কোন কমতি না থকে। অথচ বন্যায় সব ভেসে গেছে। বাড়ির কি অবস্থা সে খবরও আর জানে না আজ প্রায় তিনদিন হল। এ সব বলে বলে প্রলাপের মত খোদেজা বেগম বকছে আর বুক চাপড়িয়ে উচ্চ স্বরে কাঁদছে। ফেন্সি মাকে ধৈর্য ধরতে বলছে। ফেন্সি বলে:
– মা কেঁদো না। সব কিছু হারালেও তো আমরা বেঁচে আছি। দেখবে আবার আমরা গেরস্ত বাড়ি সাজাব, ক্ষেত খামার করব।
– আমার কি আর সে বয়স আছে মা? আমি আর পারব না, তোর বিয়েরই বা কি হবে। ঐ নতুন সম্পর্কের লোকজনেরাই কেমন আছে কে জানে। হায় আল্লাহ এ কেমন গজব দিলে তুমি!
– মা তুমি ভাবছ কেন। আমরা জেনারেশন জেডের ছেলে মেয়ে যাকে বলে জেন জি। ক’দিন আগেই আমরা সাহসের সাথে লড়াই করে আমাদের প্রানের বাংলাদেশকে ১৬ বছরের ফেসীবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত করেছি, দেশকে আবার স্বাধীন করেছি। আমরা পারব মা। তুমি শুধু দোয়া করবে। খোদেজা বেগম তখনও কাঁদছিল আর বলছিল:
– তোর বিয়ের কি হবে মা?
– সে নিয়ে তুমি ভেবো না। আগে বাঁচতে হবে। তার পরে দেখা যাবে সে সব।খোদেজা বেগম কান্না থামিয়ে বলল:
– খাওয়ার জন্য তো কিছুই নেই। শুনেছি ত্রান দিচ্ছে রাস্তার মোড়ে। ফাতেমা গেছিল?
– গেছিল মা। তবে একজনের জন্য একটিই ত্রানের ব্যাগ দিয়েছে।
– তুইও গেলি না কেন মা?
– আমার ইতস্তত লাগে মা। শুনেছি ত্রান দেয়ার সময় অনেকে ছবি তোলে। আমরা কি ভিখেরী, হতদরিদ্র? আমাদের অনেক কিছু ছিল। আজ না হয় পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আমাদেরকে হাত পেতে ত্রান নিতে হোচ্ছে। তাই বলে সে ছবি তুলে মিডিয়ায় দিবে, আমার ইচ্ছে করে না।
মা চুপ করে থাকে। এদিকে আজকেও ফাতেমা যে ত্রানটুকু পেয়েছে সে গুলোই গুছিয়ে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
খাওয়ার সময় ফাতেমা বলছিল:
– বড় মা, আমি ফেন্সি আপুর হবু শ্বশুরকে আজ ত্রান নিতে দেখেছি। কিন্তু ভীড়ের মধ্যে কোথায় যে হারিয়ে গেল আর দেখা পাইনি। খোদেজা বেগম বলে:
– ওমা বলিস কি? সাথে কি হবু জামাই ছিল?
– না উনাকে দেখিনি।
– আল্লাহ তুমি সকলকে ভালো রেখো।

এদিকে কয়েকদিন পরে বন্যার পানি সরে গিয়ে গ্রামে যাওয়ার রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে গেলেও লোকজন ঘরে ফিরতে শুরু করে। খোদেজা বেগমও আর দেরী করতে চাইল না। তারা বাড়ির দিকে রওনা দিল। বাড়ির বেহাল অবস্থা দেখে খোদেজা বেগম কাঁদতে কাঁদতে মুর্চ্ছা গেল। শরীর খারাপ করল। ফেন্সি মা’কে ঘরে নিয়ে যে কোন কিছুর উপরে শুইয়ে দিবে সে সুজোগও নেই। অগত্যা কাদা মাখা বারান্দায় ত্রানের ত্রিপাল বিছিয়ে মা’র সেবা শুশ্রুষা করা শুরু করল সে। মা একটু সুস্থ হলে মা’র হাত পা পানি দিয়ে ধুইয়ে দিল। মাথায় শক্ত কাগজের সাহায্যে বাতাস দিতে থাকল। হঠাত বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে খোদেজা বেগমের মনটা ছেঁত করে উঠল। ফেন্সিকে বলেই ফেলল দেখ তো মা তোর হবু শ্বশুর এলো কি না? দেখে সত্যিই ফেন্সির হবু শ্বশুর বাড়ির আঙ্গিনায় কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে। খোদেজা বেগম বলল:
– বিয়াইকে বসতে দে মা। বিয়াই সাহেব বসেন। কিসে আর বসতে দেবো বলেন আজ আর কিছুই নেই বাড়িতে। আমার সোনার সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে বিয়াই বলতে বলতে আবার কাঁদতে শুরু করে। বিয়াইও কাঁদতে কাঁদতে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করল:
– মুনির কি আপনাদের কাছে এসেছিল বিয়ান??
– কেন বিয়াই? মুনিরের (হবু জামাই) কি হয়েছে।
– ২৫ আগষ্ট বন্যায় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে যখন তার ভেতরেই বার বার ফেন্সি ফেন্সি নাম ধরে বলেছে ওদের কি হল বাবা? ওরা কি বেঁচে আছে? আমি ফেন্সিদের কাছে যাব। ছেলে যে এক নজর দেখে ফেন্সিকে এত ভালোবেসে ফেলেছিল তা বুঝতেই পারিনি। সেদিনই সে বিকেলের দিকে পাগলের মত আপনাদেরকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। তারপর…
– তারপর, তার পর কি হয়েছে বিয়াই, সে এখন কোথায়?
– সে খোঁজ নিতেই আপনাদের কাছে এসেছিলাম। এই বলেই তিনি আবারও কাঁদতে থাকেন।
– এ কি বলছেন আপনে। মুনির নিশ্চই আছে। সে হারিয়ে যেতে পারে না। সে অবশ্যই ফিরে আসবে।
বলতে বলতে খোদেজা বেগম আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আড়ালে থেকে ফেন্সি সব শুনছিল। সে এবার আর নিজেকে প্রবোধ দিতে পারল না। এতক্ষন মা’কে কত বুঝিয়েছ যেন সে আর কান্না না করে। কিন্তু মুনিরের কথা জানার পর সেও আর নিজেকে সামলাতে পারল না। দৌড়ে এসে হবু শ্বশুরের বুকে কান্নায় লুটে পড়ে। আর বলতে থাকে চলেই যদি যাবে মুনির তাহলে আমাকে কেন এত ভালোবেসেছিল?

২৯ আগস্ট, ২০২৪।